Physical Address
304 North Cardinal St.
Dorchester Center, MA 02124
Physical Address
304 North Cardinal St.
Dorchester Center, MA 02124

প্রাচীন ভারতের গুরুদের একটা দূর্নাম আছে তা হলো এই যে, তারা শীষ্যদের জ্ঞান দান/বিতরণে কৃপন ছিলো। আমরা সবাই একমত হবো যে জ্ঞানই শক্তি। তাহলে মনে প্রশ্ন আসতে পারে জ্ঞান যদি এতটাই শক্তি ধারণ করে তাহলে কেনো তারা জ্ঞান দানে কৃপনতা করে! গুরুদের তো শীষ্যদের ভালো চাওয়ার কথা, তাই যদি হয় তাহলে তারা শীষ্যদের কেনো বঞ্চিত করতে চায়?!
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই সময়ে মানুষের হাতে অগাধ জ্ঞানের ভান্ডার। মানুষ চাইলেই এই জ্ঞান ব্যাবহার করে যেকোন কিছু করার ক্ষমতা রাখে। এই অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার থেকে সঠিক জ্ঞান আহরন করে মানুষ অসাধ্য সাধন করে ফেলতে পারে যদিও জ্ঞান কেবল হাতে পেলেই তো হবেনা, তা কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে ব্যবহারে দেখা যায় ত্রুটি, অপারগতা, সঠিকভাবে বুঝতে না পারা, ভুল/মন্দ কাজে ব্যবহার করা ইত্যাদি ইত্যাদি। (যদিও কেউ কেউ সবার উপকারে আসে এমন কিছুতে এইসব জ্ঞান ব্যবহার করছে অন্যদিকে কেউ কেউ আবার সবার জন্য অপকারী এমন কাজে এইসব জ্ঞান ব্যবহার করছে।) তাহলে বর্তমান সময়ে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামনে অবাধ জ্ঞানের সমুদ্র যাতে আমরা চাইলেই নিজেদের সিক্ত করতে পারি, ডুব দিতে পারি, ভাসতে পারি অথবা স্নান করতে পারি। কিন্তু বাস্তবে বেশীরভাগ সময়েই দেখা যাচ্ছে আমরা সমুদ্রের সামনে গিয়ে সমুদ্রের গভীরতায় বিমুগ্ধ, হতবিহ্ববল, আলোড়িত হয়ে পড়ছি, আমরা এর বিশালতায় ভীত হয়ে উঠেছি, নগণ্যবোধ করছি। তাই সমুদ্রে হালকা পা ভিজিয়ে, পোজ দিতে ব্যস্ত হয়ে যাই। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে সবাইকে জানান দিতে চাই দেখো আমার কত সৌভাগ্য যে আমি এই এই জায়গায় ঘুরতে যেতে পারি, দেখো আমি চাইলেই সমুদ্রে স্নান করতে পারি। এখানে তাই দেখা যাচ্ছে সমুদ্রদর্শনে বা সমুদ্রস্নানে মানুষের যত না আগ্রহ তার থেকে বেশী আগ্রহ অন্যদের কাছে নিজেদের সামর্থ্য ও সামাজিক অবস্থান কতটা উচুঁতে তা জাহির/প্রদর্শন করা।
প্রাচীন ভারতের গুরুরা জ্ঞান বিতরনের আগে যাচাই করে নিতো কে কোন ক্ষেত্রে যোগ্য।কার চারিত্রিক দৃঢ়তা কেমন, কার সম্ভাবনা কতটুকু, কে ভবিষ্যতে কোন পথে আগাতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। গুরুর মনে যদি কোন সময় সন্দেহ হতো যে তার শীষ্যদের মধ্যে বিশেষ কারও ভবিষ্যতে বিপদজনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে তাহলে বিশেষ জ্ঞান বিতরনের সময় সাবধান হয়ে যেতেন, প্রয়োজনে বিরিত থাকতেন। অপাত্রে দান বা উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর গল্প আমরা যদি জানি তাহলেই বুঝতে পারবো আমাদের এইসব গুরুজন খুব ভালো করেই জানতেন দায়িত্ব পালনে তাঁকে কতটা বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে হবে, ব্যাপারটা এমনও না সব গুরুই সমান মর্যাদার তারপরও ক্ষেত্র বিবেচনায় তারা মোটামুটি সবার উপরে জ্ঞান রাখতেন। অনেক সময় তাদের নির্ণয়ে ভুল হতোনা ব্যাপারটা এমনও না, তবে বেশীরভাগ সময়েই তারা সঠিক নির্ণয়ই করে থাকতেন। উদাহরণস্বরুপঃ একলব্যের কথা চলে আসে। একলব্যকে গুরু দ্রোনা জ্ঞানদানে অস্বীকার করে এবং অস্বীকার করার সময় একলব্যকে নিচুজাত বলে ছোট করে, নানাভাবে অপমান করে, কিন্তু এতকিছুর পরেও একলব্য গুরু দ্রোনার প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়নি, গুরুকে গালমন্দ করেনি, গুরুর শিষ্যদেরকেও হিংসা করেনি। গুরু দ্রোণার প্রতি একইরকম ভক্তি রেখে গুরুর চলার পথের মাটি দিয়ে মুর্তি বানিয়ে, গুরুর মূর্তিকে গুরুজ্ঞান করে নিজে নিজেই ধনুর্বিদ্যার চর্চা করেছেন। গুরু জ্ঞানদানে অস্বীকার করলেও শিষ্য গুরুকে গুরুজ্ঞান করেছিলো, যার ফলে যাদেরকে গুরু নিজের শিষ্যজ্ঞান করেছিলো তাদের থেকেও একলব্য গুরুভক্তিতে এগিয়ে ছিলো। তাই দেখা গেলো একলব্যের মানসিক দৃঢ়তা, চারিত্রিক উৎকর্ষতা ও কঠিন সাধনার বলে অন্যসব শিষ্যের থেকে একলব্য তীর চালনায় অন্যদের চেয়ে অধিক দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। এখানে গুরু দ্রোনা একলব্যকে শিক্ষাদান থেকে বিরত ছিলেন এই কারনে যে তিনি অর্জুনকে ধনুর্বিদ্যায় সবার থেকে অধিক পারদর্শী করে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। গুরু দ্রোনা একলব্যের পারদর্শিতায় মুগ্ধ হলেও তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরন করে ম্লান হয়েছিলেন, তাই একলব্য যখন গুরু দ্রোনাকে গুরু বলে স্বীকার করেছিলো এবং ধনুর্বিদ্যায় তার পারদর্শিতায় গুরু দ্রোনার অবদানের কথা জানিয়েছিলো তখনই গুরু দ্রোনা একলব্যকে এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। গুরু দ্রোনা দাবি জানিয়েছিলেন, যদি একলব্য সত্যি সত্যিই তাকে গুরুজ্ঞান করে তাহলে সে যেনো তাকে তার পাওনা গুরুদক্ষিনা মিটিয়ে দেয়। একথায় একলব্য বলেছিলো যে, সে গুরুর যেকোন আদেশ মেনে নিতে রাজি। গুরু দ্রোনার দাবি ছিলো একলব্য হাতের এক বৃদ্ধাঙ্গুলি। মজার ব্যাপার হলো একলব্য কোনরকমে কালক্ষেপন না করেই গুরুভক্তি প্রমানে নিজের হাতের এক বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিয়েছিলো গুরুকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে।
এখনকার সময়ে এসে দেখি যে যেটা চায় তা হওয়ার সব পথ খোলা তারপরও সবাই কেমন যেনো দিশেহারা, কারন প্রকৃত গুরুর দেখা মেলে খুব কমই। যারা নিজেদের গুরু বলে দাবী করে তাদের নিজেদের কাছেই নিজেদের কোন মর্যাদা নেই, আত্নমর্যাদাহীনতায় বেশীরভাগ ভুগে থাকে। গুরু হলেই তো হবেনা, সবার আগে দেখতে হবে গুরুর চরিত্র, এখনকার মানুষদের চরিত্র বড়ই দূর্বল। লোভ, হিংসা, প্রতিযোগীতা, লোক দেখানোর লিপ্সা, পেটের চিন্তা, সামাজিক অবস্থান নিয়ে দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদি ইত্যাদি মানুষকে তাড়া করে ফেরে। যে সময়ে গুরু নিজেই জর্জরিত, দিশেহারা, দিকভ্রান্ত সে কি করে তার শিষ্যদের পথ দেখাবে? গুরু যদি নিজেই চারিত্রিকভাবে দৃঢ় না হয়, কি করে সে শিষ্যের চারিত্রিক দৃঢ়তা যাচাই করবে? গুরু কোন পথে আছে? গুরুর জীবনের উদ্দেশ্য কি? এসব যদি চিন্তায় নিম্নগামী ও প্রভাবে ক্ষুদ্র পরিসরের জন্য হয় তাহলে শীষ্যদের চিন্তা আরও নিম্নগামী ও প্রভাবে আরও ক্ষুদ্র পরিসরের জন্য হয়ে উঠবে দিন দিন, আর এটাই তো স্বাভাবিক।