Physical Address

304 North Cardinal St.
Dorchester Center, MA 02124

টুনির মহাজাগরণ

জনপ্রিয় কথাশিল্পী জহির রায়হানের “হাজার বছর ধরে” উপন্যাসে আমরা গ্রামবাংলার শ্বাশত রুপ দেখতে পাই। উপন্যাসের পটভূমি গ্রামকেন্দ্রিক হলেও এতে উল্লেখিত চরিত্রগুলো যেনো স্থান, কাল, পাত্র ছাড়িয়ে সার্বজনীন রুপে ধরা দেয়। টুনি, মন্তু, মকবুল, আম্বিয়া, আমেনা, আবুল, হালিমা, ফকিরের মা, গনু মোল্লা এইসব চরিত্রগুলোর প্রত্যেকে মিলে পুরো উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ রুপায়িত করে। টুনি বুড়ো মকবুলের তৃতীয় স্ত্রী, বয়সে কিশোরী, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। বুড়োর সংসারে এসেও টুনির জীবনে উচ্ছ্বলতা ছিলো মকবুলেরই দূর সম্পর্কের ছোট ভাই অনাথ মন্তুকে ঘিরে। বড় বউ আমেনা ও মেজো বউ ফাতেমার পর ছোট বউ হিসেবে টুনি মকবুলের জীবনে আলাদা কোন গুরুত্ব রাখেনা কেবলমাত্র সাংসারিক প্রয়োজন ছাড়া। বুড়ো মকবুলের সাথে কিশোরী টুনির আত্নিক ও মানসিক ব্যাবধান থাকলেও তরুন মন্তুর সাথে সেই সংযোগ ঘটে যায় সহজেই। তাইতো মন্তুর সাথে নানান ছুতোয় খুনসুটিতে ব্যস্ত দেখা যায় টুনিকে, দেখা যায় রাতের আধাঁরে মন্তুর সাথে টুনির অন্যের পুকুরের মাছ চুরি করার মতো নিষিদ্ধ ও রোমাঞ্চকর ঘটনা। টুনির ধূসর জীবনে মন্তু যেনো সজীবতার ছোঁয়া এনে দেয়, তাইতো শাপলা ফুলের মালায় ফুটে ওঠে মন্তুর প্রতি টুনির নিষ্পাপ ভালোবাসা। স্থুল বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে অনেকটা মন্তু ও টুনির অজান্তেই গড়ে ওঠে এক নিবিড় সম্পর্ক। ভালোবাসার অনুভূতি  আসলে এমনই, যারা ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে আছে তারা নিজেরাও অনেক সময় বুঝতে পারেনা তাদের আত্নিক অবস্থান কোথায়। ভালোবাসায় যারা জড়িয়ে তাদের বাস্তবতাবোধ লোপ পায়, এখানে সমাজ, সংসার, নিয়ম-কানুন, লাভ-লোকসান কিছুই বাধা হয়ে দাড়ায় না। ভালোবাসায় এতসব চিন্তা চলে আসলে তা ইগোর জগতে আটকা পড়ে যায়, সম্পর্কগুলো অনেকটা mind game এর মতো হয়ে ওঠে, সম্পর্কগুলো তাই আত্নিক সংযোগে আর উত্তরীত হতে পারে না। মন্তুর সাথে টুনির যে স্নিগ্ধ কোমল রুপ আমরা দেখতে পাই তাতে যে কেউ আকৃষ্ট হতে বাধ্য, সেই নিষ্কলুস, সাবলীল সম্পর্ক আমাদের সকলের মনে গভীর আকাক্ষা হয়ে ধরা দেয়। মন্তুও টুনিকে পেতে চায়, যেজন্য টুনিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো দুঃসাহসও সে দেখায়। সমাজ-সংসারের কঠোর বাস্তবতার বেড়াজালে আবদ্ধ দুটি প্রানে অস্থিরতাও দেখা যায়। মন্তুর প্রতি টুনির ভালোবাসায় নারী প্রকৃতির যে কোমল স্নিগ্ধ যত্নশীল রুপ আমরা দেখি তাকে বলা হয় light feminine energy, সনাতন ধর্মে লক্ষী, সরস্বতী, দূর্গা দেবীকে বলা যায় এই শক্তির ধারক বাহক। অন্যদিকে দেবী কালীর যে ভয়ঙ্কর ক্ষমাহীন আপোসহীন রুপ আমরা দেখি তাহলো নারীর dark feminine energy, অনাকাক্ষিত নারীর এই রুপে জগত সংসারে মারাত্নক ওলট-পালট ঘটে। dark feminine enegry কে তাই সমাজ ভয় করে, কারন ক্ষরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা নদীর মতোই এই শক্তি নির্দয় বিধ্বংসী, এই শক্তি পরোয়া করেনা কোন কিছু।

সমাজ সংসারের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে নারীর এই (light energy) কোমল শক্তির পূজো করা হয় সেখানে নারীর ভেতরের যে (dark energy) রুক্ষ শক্তি তা চাপা পড়ে (surpressed) থাকে। নারী সব সময় মেনে নেয়, মানিয়ে চলে, সমাজ সংসারের যেকোন পরিস্থিতিতে নারীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হয় আনুগত্য, যত্নশীল আচরন। নারী যখন স্রোতে গা ভাসাতে পারে তখন তার মধ্যে স্নিগ্ধ নারী শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটতে দেখা যায়, তাই light feminine energy’র মূলমন্ত্র হলো go with the flow of life. বাস্তবতা যখন নারীর জীবনে resistance force হিসেবে উপস্থিত হয় তখন নারী dark feminine energy তে switch করে। বলে রাখা ভালো নারীশক্তি আসলে এই দুই শক্তির সমন্বিত রুপ। এই দুই শক্তির ভারসাম্যেই নারী রুপ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটিকে বাদ দিলে অন্য surpressed নারী শক্তি নারীর জীবনে ভারসাম্যহীনতা তৈরী করে। এই ভারসাম্যহীনতা দেখা যায় আমাদের প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির মূলে। নারীর স্নিদ্ধ রুপের বদন্যতার গুনে নারী তার ভেতরের রুক্ষ নারী শক্তিকে (dark feminine energy) অস্বীকার করেছে যুগ যুগ ধরে, কারন আমরা সেই বস্তু বা গুনেরই চর্চা করি যার বাজার মূল্য আছে। কোন নারী dark feminine energy তে থাকলে তাকে নিয়ে সংসার করার দুঃস্বপ্ন কেউ দেখবেনা! নারী তার ভেতরের dark feminine energy’র উপস্থিতি অস্বীকার করার কারনে সেই surpressed egergy অন্য নারীকে মন্দ প্রমাণে কাজে লাগিয়েছে। এই ধরনের প্রতিযোগিতায় দেখা যায় সেইসব নারীদের যারা light feminine energy তে আছে তা প্রমান করতে চাইলেও operate করে dark feminine energy তে। এইসব নারী যারা তাদের অজান্তেই dark feminine energy তে অপারেট করে তারা অন্য নারীর সাথে তুলনায় নিজেকে better বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তুলনায় নিজেকে সেরা প্রমান করতে না পারলে তারা মেনে নিতে পারেনা, তখন তারা অন্যকে মন্দ প্রমাণে উঠেপড়ে লাগে।

উপন্যাসের শুরুতে আমরা টুনিকে দেখতে পাই light feminine energy তে, এরপর যখন মন্তুর সাথে আম্বিয়ার বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠে তখন আমরা দেখি dark feminine energy তে টুনিকে অপারেট করতে। টুনির বুদ্ধি শুনে মকবুল বুড়ো আম্বিয়াকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে শুধুমাত্র কিছু বস্তুগত সম্পদের লোভে। টুনির জীবনে যে মন্তু নীবিড়ে জড়িয়ে; তার সাথে অন্য কারো বিয়ে হলে যে সম্ভাব্য দুরুত্ব তৈরী হবে তা টুনি মেনে নিতে পারেনা। একাকী মন্তুর জীবনে টুনির অবাধ আনাগোনা, মন্তুর সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীর আবির্ভাবে তেমনটি আর থাকবেনা, এই ভয়ে চালিত টুনি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। dark feminine energy’ই আসলে এমন, যেখানে মানুষ হয় ভয়ে নাহয় লোভে চালিত হয়। ভয়, লোভ আকাংখায় যখন মানুষ চালিত হয় তখন তারা বিধ্বংসী আচরন করে, যার ফলে আমরা দেখতে পাই একটি সাজানো সংসারের ভাঙ্গনঃ প্রথমে বুড়ো মকবুলের বড় দুই বউ আমেনা ও ফাতেমার স্বামী পরিত্যাক্তা হওয়ার মতো ঘটনা, এরপর বুড়ো মকবুলের মৃত্যু। বুড়ো মকবুলের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে টুনির মধ্যে এক বোধের জাগরন হয়, তাহলো টুনি কোন একাকী অস্তিত্ব নয় তার সাথে সংসারে জড়িয়ে আরও অনেকে, তার কোন একটি কাজে কেবল তার নিজের জীবন প্রভাবিত হচ্ছে এমন নয়, আরও অনেকের জীবন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। যখন মানুষের এই বোধ আসে, তখন মানুষ আর তার নিজের কথাই কেবল ভাবতে পারেনা, নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে অন্যের ক্ষতি সে মেনে নিতে পারেনা। এই বোধে কেউ উন্নীত হতে পারলে জগত সংসারের সব আকাংখার হাতছানি তার কাছে তুচ্ছ হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায় বুড়ো মকবুলের মৃত্যুর পর টুনিকে মন্তুর দেয়া বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে। টুনির ভেতরের যে light feminine energy সেটাই শেষমেষ dark feminine energy এর বিপরীতে dominant শক্তি হিসেবে টুনিকে পরিচালিত করে; আর তাইতো টুনি চরিত্রটি স্থুল জাগতিক মোহ ছাড়িয়ে মহাজাগতিক রুপে আমাদের উন্নীত হওয়ার পথ দেখায়।

tamziadmin
tamziadmin
Articles: 75